পেঁপের ফ্ল্যাভোনয়েড হৃদরোগ, ক্যান্সার ও বার্ধক্য প্রতিরোধ করে
আয়ুর্বেদিক নাম অমৃততুম্বী এবং ইউনানী নাম পাপিতা, আরানড খরবুজা। কাঁচা পেঁপে একটি উৎকৃষ্ট মানের সব্জি আর পাকা পেঁপে উন্নত মানের পুষ্টিকর ফল; যা কাঁচা-পাকা উভয় অবস্থায় সারা বছরই পাওয়া যায়। এই সব্জি বা ফলের রয়েছে অনেক ভেষজগুণ। উৎকৃষ্ট মানের পুষ্টির খনি হল পেঁপের সব্জি, ফল, ফুল, বীচি, পাতা ও মূল। নিয়মিত এক গ্লাস
পেঁপের জুস বা ফলের রস করে খেলে দৈনিক ভিটামিন, মিনারেল ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়।
পেঁপের জুস বা ফলের রস করে খেলে দৈনিক ভিটামিন, মিনারেল ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়।
প্রতি ১০০ গ্রাম (৩.৫ আউন্স) পেঁপে (Papaya) পুষ্টিগত মান
| |
খাদ্যে শক্তি
|
32 kcal
|
ফাইবার
|
0.8g
|
শর্করা
|
7.2g
|
স্নেহ পদার্থ
|
0.1g
|
প্রোটিন
|
1.9g
|
ভিটামিন এ
|
328mg
|
ভিটামিন বি১
|
0.08mg
|
ভিটামিন বি২
|
0.05mg
|
ভিটামিন বি3
|
0.38mg
|
ভিটামিন বি6
|
0.01mg
|
ভিটামিন বি9
|
38mg
|
ভিটামিন সি
|
57mg
|
চর্বি
|
0.14g
|
ক্যালসিয়াম
|
31mg
|
খনিজ পদার্থ
|
0.7g
|
কার্বোহাইড্রেট
|
9.81g
|
ম্যাগনেসিয়াম
|
10mg
|
ফসফরাস
|
13mg
|
পটাশিয়াম
|
69mg
|
লোহা
|
00.5mg
|
সোডিয়াম
|
6.0 mg
|
পানি
|
88.4g
|
একক
μg = মাইক্রোগ্রামসমূহ,
mg = মিলিগ্রামসমূহ
IU = আন্তর্জাতিক এককসমূহ
|
পেঁপের বৈজ্ঞানিক নাম Carica Papaya, ইংরেজি নাম Papaya, আমাদের দেশের স্থানীয় নাম পেঁপে; পেঁপে আরো কিছু নামে পরিচিত যেমন- ওয়াশিংটন, হানি ডিউ, সানরাইজ, পুসা, পিপিয়া, পাপিতা, পাপতা,পাপ্পা ইত্যাদি। ফলটি বর্গ- Brassicales, Caricaceae পরিবারের সদস্য। পেঁপের আদিনিবাস কোস্টারিকা, মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চল এবং মধ্য আমেরিকায়। ১৬০০শতকের শেষার্ধে মধ্য-আমেরিকার স্থানীয় ফল পেঁপে আসে দক্ষিণ এশিয়ায়; পর্তুগীজরা নিয়ে আছে এই অঞ্চলে। এখন সারা দুনিয়ায় বিস্তার করছে মেক্সিকান ও হাওয়াই ভ্যারাইটির পেঁপে।
পুরুষ, স্ত্রী ও উভলিঙ্গী এই তিন ধরনের পেঁপে গাছ হয়। যে গাছ থেকে লম্বা নল বা ডাটা হয় এবং ডাটার মাথায় ফুল হয় ঐ গাছ হল পুরুষ-গাছ; পুরুষ ফুল তুলনামূলক ছোট, এই ফুলে ফল হয় না। আর যে গাছের কাণ্ড থেকে ফুল বের হয় সে হল স্ত্রী-গাছ, স্ত্রী ও উভলিঙ্গী ফুলে ফল হয়। উভলিঙ্গী পেঁপে গাছে একই ফুলে পুংকেশর ও গর্ভকেশর উভয়ই বিদ্যমান থাকে। সাধারণত পেঁপে গাছে ডালপালা হয় না, তবে গছের ডগা কেটে ফেললে বা ভেঙ্গে গেলে পাশ থেকে ডাল বা শাখা গজায়, ঐ শাখায়ও পেঁপে হয়। বিভিন্ন জাতের পেঁপে উৎপন্ন হয়, জাতসমূহ- আর্লিবাউন্টি, পূষা, রাঁচি, হানিডিউ, শাহী রেডলেডী, সোলা, সিমলা ইত্যাদি। হার্ম-ভ্যারাইটি জাতের পেঁপে লম্বাটে, হার্ম-পেঁপে আকারে বড় হয় এবং বেশ সুগন্ধ থাকে আর স্ত্রী-ফুল থেকে হয় গোলাকার পেঁপে। বছরের প্রায় সব ঋতুতেই পেঁপে হয়। আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এই ফল নানাভাবে ব্যবহৃত হয়।
পেঁপে ভেষজ গুণসম্পন্ন, পুষ্টিকর ও রোগ প্রতিরোধক ফল। পেঁপে শুধু বাংলাদেশে না সারা বিশ্বের জনপ্রিয় ফলের মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান ফল। স্বাদের থেকে ঔষধি ও পুষ্টি গুণের কারণেই সব দেশে সবার কাছে এই ফলের এতো সমাদর। ফলটি কাঁচা অবস্থায় খোসা (ওপরের অংশ) গাঢ় কালচে সবুজ ভিতরের খাদ্য অংশ সাদা আর পাকা অবস্থায় খোসা হলুদ বা পীত রং-এর হয়ে থাকে, পাকা পেঁপের খাদ্য অংশ লাল, কমলা ও হলদেটে রং-এর হয়ে থাকে, খেতে মিষ্টি ও রসালো। পেঁপের মাঝখানটা ফাঁকা এবং ছোট ছোট অনেক বীচি থাকে; কচি বীচির রং সাদা আর পাকা বীচির রং কালো বা ধুসর-কালো। কাঁচা পেঁপের দুধের মত কস থাকে। পেঁপে পাকা ফলের তুলনায় কাঁচা সব্জির চাহিদা অনেক বেশি। এই ফল বিভিন্ন ভাবে খাওয়া যায়, যেমন- জুস, সালাদ, হালুয়া, চাটনি, জেলি, মোরব্বা ইত্যাদি।
ফলটির রয়েছে অনেক ভেষজ, প্রাকৃতিক ও খোদায়ী গুণ। পেঁপেতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি ও সি এবং পটাশিয়াম, সোডিয়ামসহ অন্যান্য উপকারি উপাদান। এই ফল মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। রূপ-লাবণ্য বা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, অর্শরোগ, মূত্রনালির ক্ষতে, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্ত কাশি, সোরিয়াসিস, রক্তার্শে, দাঁত, আলসার, ত্বকের ঘা, একজিমা, কৃমি সংক্রমণ, রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে ও পাকস্থলীর ক্যান্সার নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
পেঁপের উন্নত মানের ভিটামিন-এ চোখের লেন্স এবং রেটিনার জারণ প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা প্রতিরোধ করে চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। বেরিবেরি রোগ, মুখের ঘা প্রতিরোধ করে ভিটামিন-বি যা পাওয়া যায় পেঁপেতে। নাইট্রোস্যামাইন ক্যান্সার হওয়ার একটি উপাদান, যাকে প্রতিরোধ করে পেঁপের উৎকৃষ্ট মানের ভিটামিন-সি।
পেঁপের শক্তিশালী বিটা ক্যারোটিন, লুটেইন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফ্ল্যাভোনয়েড নামক উপাদানগুলোর কাজ হলো হৃদরোগ, ক্যান্সার, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া (ডিমেনশিয়া), বার্ধক্য ও চোখে ছানি পড়া প্রতিরোধ করা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। উচ্চ-রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে পটাশিয়াম।
পেঁপেতে আছে অ্যানজাইম ও আঁশ বা ফাইবার; অ্যানজাইম ফ্যাট কোষগুলোকে অক্সিডেশনের মাধ্যমে শিরা-উপশিরা ব্লক করাতে বাধা প্রদান করে আর আঁশ শিরা-উপশিরার দেয়ালের কোলেস্টেরল দূর করে। আরো আছে স্যালুবল ফাইবার নামক উপাদান যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। প্যাপেইন ও ক্যাম-প্যাপেইন নামক অ্যানজাইম থাকে কাঁচা পেঁপেতে। প্যাপেইন নামক এনজাইম খাদ্য হজম করতে, ক্যাম-প্যাপেইন এনজাইম পাকস্থলীতে আমিষ হজমে সাহায্য করে।
এই ফলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহের টক্সিন উপাদান বের করে ক্যান্সার সেল জন্ম নিতে বাধা দেয়, আছে লাইকোপেন নামক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা মানব দেহকে ক্যান্সার থেকে দূরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; নিয়ম করে পরিমাণ মতো পেঁপে ফল ভক্ষণকারীদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকির আশঙ্কা অনেকাংশে কম থাকে। কার্পেইন নামক আরেকটি উপাদান আছে এই ফলে, যা গ্যাস্ট্রিকের নানা রকম সমস্যার সমাধানে ঔষধের কাজ করে।
মিষ্টি জাতীয় সব ফলই ডায়াবেটিসে ভুক্তভোগীদের জন্য ক্ষতিকর পেঁপেও এর ব্যতিক্রম নয়। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ঔষধ সেবনকারীগণ এবং গর্ভবতীগণ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে পেঁপে খাওয়া ভালো। কাঁচা পেঁপের কস বা রস চামড়ায় অ্যালার্জির হতে পারে।
পেঁপে ফুলের জাদুকরী ক্ষমতাবলে ডায়াবেটিসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। পেঁপে ফুল ভিটামিনে পরিপূর্ণ; এই ফুলে থাকে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-ই, এমন পরিমাণে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফোলেট যা দেহে কোলেস্টরেলের জারনক্রিয়াকে প্রতিহত করে আবার সরাসরি কাজ করে অ্যাথেরোস্কেলোসিস, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধে। ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডে পুরুষ পেঁপে গাছের পেঁপে ফুল খায় তিতা হিসেবে, এই ফুল তিতা হয়।
ফুল তুলে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে পানি ঝরিয়ে গরম তেল হাল্কা ভেজে সামান্য লবণ ও গোলমরিচের গুঁড়া দিয়ে গরম ভাতে অথবা শুধু ভাজা ফুল খাওয়া যায়।
পেঁপের বীজ বা বীচি ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, ফিনোটিক, ফ্ল্যাভোনয়েড ও ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস। ফসফরাস দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে আর ফিনোটিক ও ফ্ল্যাভোনয়েড কিডনি রোগের প্রতিরোধক ও হজমশক্তি বাড়ানোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। লিভারের সমস্যা (লিভার সিরোসিস বা করেফ্যাটি লিভার) জন্য পাকা পেঁপের বীচি খুব ভালো ঔষধ; অবশ্যই লিভারের ক্ষতিকারক খাদ্য এড়িয়ে চলা উচিত। পেঁপের বীচি উচ্চ রক্তচাপ কমাতে খুবই সহায়ক। পেঁপে বীচি প্রোটিওলাইটিক উৎসেচক, দেহের ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে থাকে। কাঁচা পেঁপের বীচি কৃমিনাশক, প্রাকৃতিক গর্ভ-নিরোধক পেঁপের বীচি ও গাছের শেকড়। পেঁপের বীচি খেতে ঝাঝালো স্বাদের।
বীচি আস্ত বা গুঁড়ো (এক চা চামচ) এমনি খওয়া যায়, না পারলে মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। একটানা কোনকিছু খাওয়াই ভালো না পেঁপের বীচ খাওয়া ঠিক নয়।
পেঁপে পাতা ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে পরিচিত। কার্পেইন, অ্যাচেটোজেনিন নামক উপাদান আছে পেঁপে পাতায়; কার্পেইন ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস পাকস্থলী ভালো রাখে আর অ্যাচেটোজেনিন ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে এবং দেহ থেকে বের করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বিশেষ করে লিভার স্তন জরায়ু ফুসফুস প্রোস্টেট ক্যান্সার; এই পাতার চা কোমোথেরাপী বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয় আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমিয়ে দেয়। আছে পটাশিয়াম ও নিয়াসিন যা হার্ট সুস্থ রাখে, অ্যামাইলেইজ এনজাইম, প্রোটিজ এনজাইম ও প্যাপেইন যা যব, গম বা ভুট্টা জাতীয় খাবারের গ্লুটেন ভেঙ্গে হজম করতে সাহায্য করে। এই ফলের পাতার রস খেলে ঋতুকালীন সময়ের যন্ত্রণা উপশম পাওয়া যায়।
গর্ভবতীদের অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই পেঁপে গাছের পাতা দিয়ে চা খায়, যা ম্যালেরিয়ার নিরাময়ক।
পেঁপের কচি পাতা রস প্রাপ্তবয়স্করা(১০ml), শিশু ৫-১২ বছর (০৫ml) আর পাঁচ বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের (২.৫ml) পরিমাণে ৮ ঘণ্টা ব্যবধানে দিনে দুই বার খেতে হবে। পাতার রসের সাথে চিনি বা লবণ কোনটাই মেশানো যাবে না।
রূপচর্চার জন্য পেঁপে খুবই উপকারী উপাদান। পাকা পেঁপের সাথে মধু বা দুধ মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে অথবা শুধু পাকা পেঁপে চটকে মুখে ও চুলে লাগালে উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়।
গ্রামের প্রায় বাড়ির আশপাশের খোলা জায়গায় কিংবা উঠোনে কোণায় দু’একটা পেঁপে গাছ থাকেই। বীজের মাধ্যমে পেঁপের বংশবিস্তার করা হয়। পেঁপে গাছ শাখাবিহীন সরু ও লম্বা আকৃতির বৃক্ষ, পাতা লম্বা বোটা বা নলযুক্ত ছাত্রা মতো অনেকটাই বড়। পেঁপে গাছ ভঙ্গুর চিরহরিৎ ও দ্বিবীজপত্রী আর কাণ্ড নরম ও কিঞ্চিৎ ফাঁপা। বেলে দোঁয়াশ বা দোঁয়াশ মাটিতে পেঁপে চাষের জন্য উপযোগী।
যাদের বাড়ির আঙ্গিনায় পেঁপে গাছ নাই তাঁরা অন্তত একটি পেঁপে গাছ লাগান, নিজেদের পুষ্টি চাহিদা নিজেরাই পূরণে করুন।
No comments:
Post a Comment